পাঁচবিবি: নামকরণের রহস্য ও ঐতিহাসিক উপাখ্যান

প্রাচীন জনপদের নামের ইতিকথা
জয়পুরহাট জেলার হৃদয়ে অবস্থিত পাঁচবিবি উপজেলা তার নামকরণ নিয়ে বহু কাল ধরে বহন করে চলেছে নানা রহস্যময় গল্প। এই নামের উৎস সন্ধানে ইতিহাসবিদ, স্থানীয় গবেষক এবং সাধারণ মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় একাধিক চমকপ্রদ কাহিনী। প্রতিটি তত্ত্বই এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের স্বাক্ষর বহন করে।
নামকরণের চারটি প্রধান তত্ত্ব
১. পাঁচ পুণ্যবতী নারীর আধ্যাত্মিক স্মৃতি
সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় এই তত্ত্ব অনুসারে:
- খাসবাগুড়ী এলাকায় বসবাস করতেন এক সুফি সাধক
- তার পাঁচ স্ত্রী (বিবি) ছিলেন অসাধারণ পুণ্যবতী
- তাদের মৃত্যুর পর স্থানীয়রা পাঁচটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন
- এই স্থান “পাঁচবিবি দরগাহ” নামে পরিচিতি পায়
- কালক্রমে সমগ্র অঞ্চল এই নামে অভিহিত হতে শুরু করে
২. প্রাচীন পঞ্চগৌড় রাজ্যের স্মৃতি
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. মো. শহীদুল্লাহর গবেষণা নির্দেশ করে:
- পাল আমলে এই অঞ্চল ছিল পঞ্চগৌড় রাজ্যের অংশ
- ভাষাগত বিবর্তনে “পঞ্চগৌড়” > “পঞ্চগৌরী” > “পাঁচবিবি” রূপ নেয়
- স্থানীয় উচ্চারণে “গৌড়” শব্দের রূপান্তর বিশেষভাবে লক্ষণীয়
৩. পারস্য বণিকদের ভাষাগত প্রভাব
মুঘল আমলের বাণিজ্যিক ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য:
- পারস্য বণিকরা স্থানটিকে “পানসিভার” নামে ডাকত
- ফারসি এই শব্দের অর্থ “পাঁচটি প্রস্রবণ/ঝর্ণা”
- স্থানীয় বাংলা উচ্চারণে এটি “পাঁচবিবি”-তে রূপান্তরিত হয়
৪. ব্রিটিশ আমলের রেলওয়ে ইতিহাস
১৮৬৮ সালের সরকারি দলিলে উল্লিখিত:
- রেললাইন স্থাপনের জন্য পাঞ্চাবিবি নামী এক মহিলা জমি দান করেন
- তার সম্মানে রেলস্টেশনের নামকরণ হয় “পাঁচবিবি”
- প্রশাসনিক কার্যক্রমে এই নাম গৃহীত হয়
ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ
জয়পুরহাট জেলা গেজেটিয়ার (১৯৯৭) এর তথ্যানুযায়ী:
- ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি “লালবাজার থানা” নামে পরিচিত ছিল
- ছোট যমুনা নদীর ভাঙ্গনের ফলে প্রশাসনিক সদর স্থানান্তরিত হয়
- নতুন অবস্থানের সরকারি নাম হয় “পাঁচবিবি”
স্থানীয় বাসিন্দাদের স্মৃতিচারণ
খাসবাগুড়ী গ্রামের প্রবীণ হাজী আব্দুর রহিম (৮৫) বলেন:
“আমার শৈশব থেকে শুনে আসছি এই অঞ্চলে পাঁচজন আধ্যাত্মিক নারীর মাজার ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দরগাহ প্রাঙ্গণে জিকিরের আয়োজন হতো। আমাদের পূর্বপুরুষরা এই পাঁচ বিবিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।”
ঐতিহাসিক সময়রেখা
| সময়কাল | গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা |
|---|---|
| ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ (আনুমানিক) | পাঁচ বিবির মাজার প্রতিষ্ঠা |
| ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ | লালবাজার থেকে পাঁচবিবিতে থানা স্থানান্তর |
| ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ | পাঁচবিবি উপজেলার মর্যাদা লাভ |
নামকরণের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
পাঁচবিবি নামটি কেবল একটি ভৌগোলিক পরিচয়ই নয়, এটি এই অঞ্চলের বহুস্তরীণ সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারক। নামের উৎস নিয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও সব কটি তত্ত্বই এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষ্য দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাঁচ বিবির মাজার সম্পর্কিত তত্ত্বটিই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, কেননা এটি স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে শতাব্দীকাল ধরে বেঁচে আছে।
এই নামকরণের ইতিহাস শুধু অতীতের স্মারকই নয়, বরং এটি পাঁচবিবির বর্তমান প্রজন্মকে তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। নামের পেছনের এই সব গল্প-কাহিনী পাঁচবিবিকে একটি অনন্য পরিচয় দান করেছে।



